সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোথায় চলেছে ভারত?

জহিরুল চৌধুরী 


এক সময় ভারতের সমাজ জীবন পশ্চাদপদ হলেও রাজনীতি ছিল অগ্রগামী। ভারতের উদার গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সেই ধারা আজ আর অবশিষ্ট নেই। গণতন্ত্রের হাত ধরে হিন্দু মৌলবাদী ধারার সূচনা হয়েছে। ফলে পশ্চাদপদ সমাজ মনষ্কতা এখন রাজনীতির কেন্দ্রে।

এশিয়ার বেশ কিছু দেশে এখনো ধর্মীয় মৌলবাদী কিংবা মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার রাজনীতি ক্রিয়াশীল। চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের আরব (সৌদি আরব, আমিরাত) এবং অনারব (ইসরায়েল, ইরান) দেশগুলো এসবের অন্তর্ভূক্ত। এসব দেশের সমাজ ব্যবস্থার মৌলবাদী ধারা এখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রক।

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া কিংবা চায়নার মত দেশগুলোও এখন নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বাইরে কোনো পদক্ষেপ এমন কি কথা বলতেও রাজি নয়। পরিণামে আমরা একটি অশান্ত পৃথিবীতে প্রতিদিন নি:শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি। হয়ত এমন দিনও বেশি দূরে নয়, যেদিন বৃহৎ শক্তির স্বার্থের দ্বন্দ্বে ক্ষুদ্র দেশগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে সীমিত যুদ্ধে জড়িয়ে রক্তপাতে অবতীর্ণ হবে।

আমরা যখন ভারতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অন্বেষণ করবো, তখন আমরা চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিকেও বিবেচনায় নেব। বিশ্ব এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কানেক্টেড। এটা যেমন ভালো দিক। তেমনি মন্দের দিক হলো- অশুভ শক্তি খুব সহজে মানুষকে প্রতারিত করার একটি ফাঁদ প্রস্তুত করে রেখেছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার শিরোনাম- “ভারত বাংলাদেশকে বলেছে- আসামের জাতীয়তা নিরীক্ষণ কার্যক্রম দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়” (NRC process in Assam an internal matter, India tells Bangladesh)। রিপোর্টের ভাষ্য অনুযায়ী ভারতের এই মন্তব্যে বাংলাদেশ নিশ্চুপ!

গত কিছুদিন থেকে আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি মিডিয়ায় ভারতের সাম্প্রদায়িক সহিংস পরিস্থিতির উপর রিপোর্ট পড়েছি। এ সব রিপোর্টের অনেকগুলো বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আসেনি।

আমার ধারণা- এসব রিপোর্টে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাংলাদেশের নাগরিকরা মর্মাহত হবেন। কারণ বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে, কিংবা মৌলবাদী জামাত-শিবির চক্রের উস্কানি ছাড়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কখনো বিনষ্ট হয়নি। আরেকটি বড় কারণ- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারনে ধর্মীয় সহিংসতার উৎস এবং কারন আমাদের জানা।

সহিংসতার পক্ষে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির অব্যাহত প্রচারণা চলছে। একই সঙ্গে চলছে ‘ডিভাইড এণ্ড রুল’ পলিসি। ফলে সেদেশের অনেক মানুষও এখন মনে করেন- ভারতের সকল পিছিয়ে পড়ার কারণ হলো মুসলমানরা। কিংবা বাংলাদেশ থেকে আগত উটকো মানুষ! কিংবা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি পাকিস্তানের অব্যাহত মদত।

বিশেষ করে গত কয়েকদিন নিউইয়র্ক টাইমস পর পর কয়েকটি রিপোর্ট করেছে ভারতের সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি নিয়ে। এসবের মূল কথা মোদী সরকারের “সাম্প্রদায়িক বিভেদাত্মক” নীতি সম্পর্কিত। বিজেপি ভারত রাষ্ট্রটিকে সাম্প্রদায়িকতার পাল তুলে আসলে কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে?

ভারত একটি বিশাল দেশ। ১২ লক্ষ ৬৯ হাজার বর্গমাইল। জনসংখ্যা ১৩৬ কোটির মত। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ২২ গুন বড়। আর জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের চেয়ে ৮ গুন। বাংলাদেশে যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে ২৮৮৯, ভারতে সেখানে ১৭২।

চলুন নজর ফেরাই ভারতের তুলনামূলক জনমিতির উপর। ২০০১ সালের লোক গণনা অনুযায়ী ভারতে হিন্দুর সংখ্যা ৮০.৫ ভাগ, মুসলিম ১৩.৪ ভাগ, খ্রিস্টান ২.৩ ভাগ এবং শিখ ১.৯ ভাগ। বৌদ্ধ এবং জৈন যথাক্রমে .৮ ও .৪ ভাগ। বাদবাকি প্রায় ১ শতাংশ অন্যান্য ধর্মালম্বী।

ভারতের ২৭টি প্রদেশের সবগুলোতে আবার হিন্দু ধর্মালম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। যেমন- মনিপুর, অরুনাচল, মিজোরাম, লাক্ষাদ্বীপ, নাগাল্যান্ড, পান্জাব, জম্মু এবং কাশ্মীর। এরমধ্যে লাক্ষাদ্বীপ, জ্ম্মু এবং কাশ্মীরে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য।

ভারতের যে সব সব রাজ্যে মুসলমানরা মোটামুটি তুলনা করার মত সেগুলো হলো- আসাম (৩১%), পশ্চিম বাংলা (২৫ শতাংশ), কেরালা (২৫ শতাংশ), উত্তর প্রদেশ (১৮.৫%) এবং বিহার (১৬.৫%)।

আমার এই লেখাটা খুব প্রয়োজনীয় ছিল না, যদি ভারতে এখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে না পড়ত। ভারতে যে সাম্প্রদায়িক প্রোফাইলিং চলছে তাতে বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন। কারন ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ক্ষত খুব গভীর। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নিরিহ মানুষ বলি হয়েছে সাম্প্রদায়িক কিংবা ধর্মীয় রেষারেষির যূপকাষ্ঠে।

গত প্রায় এক দশক ধরে বিজেপির শাসন ভারতবর্ষকে আতঙ্ক এবং ধর্মীয় উন্মাদনা ছাড়া আর কিছু উপহার দিতে পারেনি। পাকিস্তান মুসলিম লীগের মত বিজেপি একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল। এর জন্ম রাষ্ট্রীয় সেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) এবং জনসঙ্ঘের উদরে ১৯৮০ সালে।

১৯৮৪ সালে লোকসভার ৫৩৩টি আসনের মধ্যে মাত্র ২টিতে জিতে বিজেপি তার যাত্রা শুরু করে ধীরে ধীরে এটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্থলে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে ফেলেছে। ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৩০৩টি, প্রাপ্ত ভোটের অঙ্কে ৩৭ শতাংশের বেশি।

গত পরশু নিউইয়র্ক টাইমসের শিরোনাম ছিল- India Plans Big Detention Camps for Migrants. Muslims Are Afraid. রিপোর্টে বলা হয়েছে- ভারতে প্রায় ৪০ লাখ লোক, যাদের প্রায় সবাই মুসলিম, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

চরমপন্থী মোদীর দল দেশটির বহুত্ববাদী চরিত্র পাল্টে একটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে। যারাই নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হবে, তাদেরকেই রাখা হবে ডিটেনশন সেন্টারে।

ক’দিন আগে একই পত্রিকায় কাশ্মীর সম্পর্কিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল Inside Kashmir, Cut Off From the World: ‘A Living Hell’ of Anger and Fear

টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টের কথা বলছিলাম। যেখানে অনুরাগ কুমার নামে জনৈক মন্তব্য করেছেন-
Kick out Bangladeshi Rohingya Muslims. They will make assam another kashmir in next 50 years and demand freedom

এর মর্মার্থ হলো- বাংলাদেশী রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে পাছায় লাথি দিয়ে বের করে দাও। এরা ৫০ বছর পর আসামকে আরেকটি কাশ্মীর বানাবে। এরপর স্বাধীনতা দাবি করবে।

মানায়াম রাজা নাগ নামে একজন এর প্রতিউত্তরে লিখেছেন- All the utracities committed by BJP is an internal matter. মর্মার্থ দাঁড়ায় বিজেপি গৃহীত সমস্ত পদক্ষেপ তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অংশ।

এর উত্তরে অনুরাগ কুমার আবার লিখছেন- So do you want Bangladeshi Muslims to Stay in India.. If you are that generous adopt them! অর্থ দাঁড়ায়- তাহলে কি তুমি চাও যে বাংলাদেশী মুসলিমরা ভারতে থাকুক? তোমার যখন এত দরদ, তাদেরকে দত্তক নিয়ে নাও।

ভারতীয় নাগরিকদের একাংশকে বিজেপি বুঝাতে সক্ষম হয়েছে- বাংলাদেশের মানুষ ভূখা নাঙ্গা। তাদের কোনো আশ্রয় নেই! পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি এমন মর্যাদাহীন ধারণা কোনো সভ্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না।

আমি এখনো মনে করি- গান্ধী, নেহেরু, ইন্দিরা, মাওলানা আজাদ কিংবা রবীন্দ্রনাথ, নেতাজীর ভারতে শুভবুদ্ধি এখনো নিশ্বেষ হয়ে যায় নি। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ঠেলে একটি অসাম্প্রদায়িক ধারার জাগরণ ঘটবে পুরো ভারতবর্ষে। সেই জাগরণের স্রোতে সামিল হবে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই। সেই লক্ষে মানবতার প্রতি আমাদের অঙ্গীকারে যেন কখনো ক্ষয় না ধরে!

নিউইয়র্ক, ২২শে অগাস্ট ২০১৯

Comments are closed.

More News Of This Category